বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ও উন্নতির জন্য সুলতানি ও মুঘল শাসনকালের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ বিষয়ে প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন তিনি হলেন ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯৩-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর শাসনকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর প্রণয়মূলক কাব্য 'ইউসুফ-জুলেখা' রচনা করেন। এটি ফার্সি রচনার অনুবাদ । সুলতানি যুগে আরও কয়েকজন কবি ফার্সি কাব্যের অনুবাদ করেছেন। তাঁদের মধ্যে দৌলত উজির বাহরাম খান ও দোনা গাজীর নাম উল্লেখযোগ্য ।
বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক সাহিত্য রচনার পথপ্রদর্শক হিসেবে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয় । ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক মুসলমান কবি বিজয়কাব্য রচনা করেছেন । বিজয়কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ‘রসুল বিজয়' কাব্য রচয়িতা জয়নুদ্দীন । বাংলার মুসলমান কবিরা পদাবলি রচনা করেন। চাঁদ কাজী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম পদাবলি কাব্যের স্রষ্টা। পিরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এ যুগে মুসলমান কবিরা অনেক কাব্য বাংলায় রচনা করেন। বাংলা ভাষায় মুসলমানরা সঙ্গীতবিদ্যার চর্চাও করেছিলেন । বাংলা সাহিত্যে সঙ্গীতবিদ্যার ওপর রচিত প্রথম গ্রন্থ 'রাগমালা' রচনা করেছিলেন কবি ফয়জুল্লাহ্ । কবি মোজাম্মেল ‘নীতিশাস্ত্র বার্তা' ও ‘সাতনামা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও মুসলমান কবিদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে । বহু আরবি ও ফার্সি শব্দ তাঁরা বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেছেন । আল্লাহ, খোদা, নবি, পয়গম্বর, কিতাব ইত্যাদি বহু শব্দ সে সময়ের মুসলমান কবি-লেখকদের ব্যবহারের ফলে বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে । সুলতানি যুগে হিন্দু কবিরাও সাহিত্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। এক্ষেত্রে মুসলমান শাসকবর্গের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে । বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশ হুসেন শাহের শাসনকালকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছে। এ যুগের বিখ্যাত কবি ও লেখকগণের মধ্যে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, মালাধর বসু, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস ও যশোরাজ খান উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এ সময়ে মালাধর বসু ‘শ্রীমঙ্গবাদ’ও ‘পুরাণ’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন । সুলতান হুসেন শাহ ও নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘মহাভারত’ বাংলায় অনুবাদ করেন ।
বৈষ্ণব কবি হিসেবে বৃন্দাবন দাসের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষায় তিনিই সর্বপ্রথম শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনচরিত গ্রন্থ 'চৈতন্য-ভগবত' রচনা করেন । চন্দ্রাবতী ‘মনসা মঙ্গল' কাব্য রচনা করেছিলেন । সংস্কৃত সাহিত্যেও মুসলমান সুলতানগণের যথেষ্ট অবদান ছিল। সংস্কৃত ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এজন্য অনেক মুসলমান শাসক এর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সংস্কৃত ভাষার চর্চাও করতেন । মুসলমান শাসনকালে বাংলা সংস্কৃত সাহিত্যের এক বিরাট কেন্দ্র ছিল । শুধু বাংলা ও সংস্কৃতই নয়, আরবি ও ফার্সি কাব্যের চর্চাও সুলতানি যুগে ছিল । মুঘল যুগে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তবে মুঘল শাসকগণ সুলতানি যুগের শাসকদের মতো ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কোনো সহযোগিতা করেননি। বাংলার জমিদারগণ স্বীয় প্রচেষ্টায় সে ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন ।
মুসলমান যুগে প্রতিবেশী আরাকানের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল । ফলে আরাকানে বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটতে শুরু করে । আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন দৌলত কাজী। আলাওল ছিলেন রাজসভার আর একজন কবি । তাঁর ছয়টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে 'পদ্মাবতী' সর্বশ্রেষ্ঠ । তিনি কয়েকটি ফার্সি কাব্যগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন । এছাড়া, ‘রাগনামা' নামে একটি সঙ্গীতশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছিলেন । বাহরাম খান রচনা করেন 'লাইলী-মজনু' কাব্যগ্রন্থ । 'জঙ্গনামা' ও 'হিতজ্ঞান বাণী' গ্রন্থগুলো কবি কাজী হায়াৎ মাহমুদ রচিত । কবি শাহ গরীবুল্লাহ ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ পুঁথি সাহিত্যিক ।
আরও দেখুন...